আমরা যখন যাকাত নিয়ে কথা বলি, তখন আমাদের মনে প্রথমেই আসে ধর্মীয় দায়িত্ব। প্রতিবছর কিছু অর্থ দান করি, গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করি—ব্যস, কাজ শেষ।
কিন্তু মালয়েশিয়ার সেলাঙ্গর রাজ্য যাকাতের পুরো বিষয়টাকেই ম্যানেজ করছে ভিন্নভাবে।
সেখানে যাকাত মানে একটা সম্ভাবনার শুরু। সেখানে যাকাত মানে সহানুভূতির পাশাপাশি পরিকল্পনা। আর এর পেছনে যে প্রতিষ্ঠানটা কাজ করছে, তার নাম লেমবাগা যাকাত সেলাঙ্গর (LZS)।
তারা কেবল যাকাত সংগ্রহ করে না—তারা জীবন গড়ে
LZS মূলত সেলাঙ্গর রাজ্যের মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহ করে এবং তা বণ্টন করে যাদের দরকার, ঠিক তাদের কাছে। কিন্তু যেটা তাদের আলাদা করে তোলে, সেটা হলো—তারা শুধু সহায়তা দেয় না, তারা স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথ দেখায়।
২০২৩ সালে তারা প্রায় ১.১ বিলিয়ন রিঙ্গিত যাকাত সংগ্রহ করেছে। ভাবছেন, এত টাকায় কী করে?
চলুন, একটু ঘুরে দেখা যাক।
যাকাত কাদের জন্য? LZS যেভাবে বণ্টন করে
LZS পাঁচটি প্রধান খাতে যাকাত বণ্টন করে—
১. সামাজিক সহায়তা – যেমন খাবার, বাসস্থান, চিকিৎসা, ও আর্থিক সাহায্য
২. শিক্ষা সহায়তা – বাচ্চাদের স্কুল ফি, বৃত্তি, কিতাব, ইউনিফর্ম, এমনকি শিক্ষক ভাতা পর্যন্ত
৩. অর্থনৈতিক উন্নয়ন – এইখানেই আসছে আমাদের মূল আলোচনার বিষয়!
৪. মানবিক ও আত্মিক উন্নয়ন – আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা, ধর্মীয় চর্চা সবকিছুর উন্নয়ন
৫. মসজিদ ও ইসলামি প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন – নতুন মসজিদ, মাদ্রাসা, পরিবহন ইত্যাদি
সবটাই সুন্দরভাবে পরিকল্পিত। তবে যার কথা না বললেই নয়, তা হলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মসূচি।
ব্যবসার পুঁজি, প্রশিক্ষণ আর সাহস – এই তিনেই বদল আসে
একজন মা, স্বামী অসুস্থ। ছোট ছোট পাঁচটা মুখ তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘরে খাবার নেই, আয় নেই, আশাও যেন নেই।
ঠিক তখনই ফাতিমাহ উমার নামে এই নারী LZS-এর কাছে যান। আর সেখান থেকে শুরু হয় তার নতুন যাত্রা।
LZS তাকে শুধু টাকা দেয়নি—তাকে দিয়েছে ব্যবসার পুঁজি, রান্নার প্রশিক্ষণ, কীভাবে বিক্রি করতে হয়, কীভাবে হিসাব রাখতে হয়—এসব কিছু।
আজ ফাতিমাহ একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার রান্নার ব্যবসা চলছে দারুণ, সন্তানদের পড়ালেখা চলছে ঠিকঠাক, আর যাকাতের ওপর আর নির্ভর করতে হচ্ছে না। সবথেকে চমৎকার বিষয় হচ্ছে যেই ফাতিমাহ উমার ২০১৯ সালে যাকাত নিয়েছেন, মাত্র কয়েকবছরের মাথাতেই ২০২২ সাল থেকে তিনি নিজেই যাকাত দিচ্ছেন।
এমন বহু গল্প আছে। ২০২৩ সালে LZS তাদের অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যয় করেছে ১৩.৯ মিলিয়ন রিঙ্গিত। ব্যবসার সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ, এমনকি কৃষিকাজ, মাছ চাষ, দোকানদারি সবখানেই সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
এটাই আসল দৃষ্টিভঙ্গি—সহায়তা দিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়াতে শেখানো।
একজন যাকাত গ্রহীতা, এখন একজন ডাক্তার!
শুধু ব্যবসা না, পড়াশোনাতেও LZS দারুণ সহায়তা করে।
সিতি নুর রাহা—এক সময়ের দরিদ্র ছাত্রী, যিনি LZS-এর সহায়তায় স্কুল, কলেজ, মেডিকেল শেষ করেছেন। আজ তিনি একজন ডাক্তার, নিজের ক্লিনিক চালাচ্ছেন সেপাং-এ।
ভাবা যায়? যাকাতের টাকায় একদিন যে মেয়ে স্কুলে যেতে পারতো না, সে আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষকে চিকিৎসা দিচ্ছে।
কেন এটা এত ভালোভাবে কাজ করে?
কারণ, LZS কেবল দান করে না—তারা দায়িত্ব নেয়।
তাদের পুরো সিস্টেমটাই ডিজিটাল ও স্বচ্ছ। সব অর্থ লেনদেন হয় ট্র্যাক করে, নিরীক্ষা করে (অডিট), আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সার্টিফায়েড (ISO 9001, ISO 37001)।
আর সবচেয়ে ভালো লাগার বিষয়? তারা মানুষকে যাকাত দেয়, যাতে আজকের যাকাত গ্রহীতা আগামীদিনের যাকাত দাতা হতে পারে।
এগিয়ে যাচ্ছে তারা, বদলে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ
২০২৩ সালে তারা ঘোষণা দিয়েছে—২০৩০ সালের মধ্যে ১,৫৭,০০০ দরিদ্র পরিবারকে সাহায্য করবে, আর চেষ্টা করছে ১৪.৭ মিলিয়ন মুসলমানকে যাকাত দেওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে।
নতুন নতুন উদ্যোগ আসছে—ডিজিটাল যাকাত সিস্টেম, অনলাইন ট্রেনিং, উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রোগ্রাম—সব মিলিয়ে, এটা এখন আর শুধু দান নয়, এটা পুরো একটা ইকোসিস্টেম।
শেষ কথা: আপনার যাকাত একটা গল্প শুরু করতে পারে
একটা যাকাত হয়তো আপনার জন্য বড় কিছু না। কিন্তু সেটাই হতে পারে কারও জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার শুরু।
একজন মা নিজের ব্যবসা গড়লেন, একজন মেয়ে ডাক্তার হলেন, একজন যুবক জেলে থেকে মাছ ব্যবসার মালিক হলেন—এই সবই হয়েছে কারও একটুখানি যাকাতে।
LZS দেখিয়ে দিচ্ছে—যাকাত শুধু সাহায্য নয়, এটা ভবিষ্যৎ গড়ার হাতিয়ার।
আরও জানতে দেখুন এখানে